তানজিদ শুভ :
পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ড ও ইউনিয়ের ৩ টির মধ্যে ২ টি তেই ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে একক ভাবে কাজির দায়িত্ব দখল করে আছেন পরশুরাম উপজেলা যুবলীগের সভাপতি কাজী ইয়াছিন শরীফ মজুমদার।
জানা যায়, ২০১১ সালে ছাত্রলীগের নেতা থাকাকালীন জেলা রেজিস্ট্রার হতে পরশুরাম পৌরসভার ০৫ নং ওয়ার্ডের জন্য নিয়োগ নেন তিনি। তবে একটি নিদিষ্ট ওয়ার্ডের নিয়োগ পেলেও জোরপূর্বকভাবে পুরো পৌরসভার পাশাপাশি উপজেলার ৩ টি ইউনিয়নের ২ ইউনিয়নে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি নিকা রেজিস্ট্রির সময় তার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক থাকলেও তিনি অনুষ্ঠানে না গিয়ে তার অবৈধ নিয়োগকৃত এজেন্টদের পাঠান। যেখানে গেজেট অনুযায়ী রেজিস্ট্রার না থাকলে তার লাইসেন্স বাতিল করে গ্রেফতারের নিয়ম ও রয়েছে। তবে কোনো নিয়মনীতিই যেন তোয়াক্কা করছে না যুবলীগের এই নেতা। অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক তথ্য মতে, যুবলীগের এই নেতার নিয়োগ প্রক্রিয়াটিও ছিল অনিয়মের মধ্যে। যেখানে শিক্ষাগত যোগ্যতায় মাদ্রাসায় আলিম পাশ বাধ্যতামূলক, ইয়াছিনের সেই সার্টিফিকেট নিয়েও রয়েছে নানান দ্বিধাদ্বন্দ্ব। এছাড়া তার শ্বশুর সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আ’লীগের সভাপতি কামাল উদ্দিন মজুমদারের প্রভাব খাটিয়ে শূন্য পদে` কাউকে নিয়োগের প্রার্থী হতেই দিচ্ছেন না তিনি।
এদিকে মাসোয়ারার ভিত্তিতে যুবলীগ নেতা ইয়াছিন শরীফ পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডেই তার স্বঘোষিত নিয়োগেই নিকা রেজিস্ট্রি করে যাচ্ছে। পৌরসভার এ ও বি মোট ৬ টি ওয়ার্ডে রেজিষ্ট্রির কাজ করছে শেখ ফরিদ এবং সি’র ৩ টি ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করছে এ.কে.এম এমরান হোসেন। তাদের ভাষ্যমতে, মাসিক ৫-৯ টি নিকা সম্পন্ন হলে গড়ে প্রতি মাসে ৭ টি নিকা সম্পন্ন হচ্ছে প্রতিটি ওয়ার্ডে। হিসাব অনুয়ায়ী ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত কাবিন হলে ১৪শ টাকা পায় কাজিরা এবং তার ঊর্ধ্বে প্রতি লাখে ১শ করে। তাহলে হিস্যা অনুযায়ী, প্রতি ওয়ার্ডে গড়ে ৭ টি বিয়ে হলে ৯টি ওয়ার্ড মিলে মাসিক আয় ৪ লক্ষ ৪১ হাজার যা বছরে দাঁড়ায় ৫২ লক্ষ ৯২ হাজার টাকায়, ১৩ বছরের হিসাবে ৬ কোটি ৮৭ লক্ষ ৯৬ হাজার টাকা।
যেখানে নিয়োগ ব্যাতীত পৌরসভার ৬ টি ওয়ার্ড থেকে অবৈধ আয় ৪ কোটি ৫৮ লক্ষ ৬৪ হাজার টাকা করেন তিনি।
এছাড়াও প্রায় ৫ বছর আগে পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের কাজি মারা যাওয়ার পর, আব্দুল মান্নান নামে একজনকে দায়িত্ব দিয়ে কাজির কাজ চালাচ্ছে ইয়াছিন। ইউনিয়নের হিসাব অনুয়ায়ী, মাসিক গড়প্রতি ১২টি নিকা হতে মাসে অবৈধ আয় ৮৪ হাজার টাকা, বছরে আয় করেছে ১০ লক্ষ ৮ হাজার টাকা। সর্বমোট ৫ বছরে ইউনিয়নটি থেকেও আয় করেছে অর্ধকোটি (৫০ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা)।
এছাড়াও নিকা রেজিস্ট্রির ৩ মাস পর কাবিননামা উঠানো বাবদও প্রতি কাবিননামা থেকে ৫শ টাকা করে নিলে গড়প্রতি ৪৩ টি নিকার কাবিননামা হতে ২১ হাজার ৫শ টাকা আয় হচ্ছে। বার্ষিক আয় হচ্ছে প্রায় লক্ষাধিক টাকা।
শ্বশুরের প্রভাব খাটিয়ে একচাটিয়া কাজি পাড়া দখল করে যুবলীগের এই নেতার মাসিক আয় দাঁড়ায় প্রায় ৫ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। হিসেব অনুযায়ী ১৩ বছর থেকে অধ্যবদি পৌরসভা ও ইউনিয়নে কাজির রেজিস্ট্রি বাবদ ইয়াছিন শরীফের অবৈধ আয় হয়েছে এখন পর্যন্ত ৫ কোটি ৯ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা।
তাছাড়া পরশুরামের বক্সমাহমুদ ইউনিয়নেও একই কায়দায় কাজির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
অবৈধভাবে নিকা রেজিস্ট্রির বিষয়ে ইয়াছিনের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বঘোষিত কাজি এমরান বলেন, তিনি ইয়াছিন থেকে নিয়োগ নিয়ে ১১ সাল থেকে অদ্যবধি ১৩ বছর কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এছাড়াও নিকা রেজিস্ট্রির কাজেও ইয়াছিন আসে না এবং রেজিষ্ট্রার বই নিয়ে গিয়ে তিনি রেজিষ্ট্রির কাজ করেন বলে স্বীকার করেন।
এছাড়া মাসোয়ারার ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত দাবী করা কাজি শেখ ফরিদ জানান, আমি ইয়াছিন ভাইয়ের হয়ে কাজ করি। ওনি আমাকে মাসে কিছু টাকা দেই। এর বেশি কিছু তো আমি জানি না।
এতসব অভিযোগের বিষয়ে ইয়াছিন শরীফ ফেনীর প্রত্যয়কে জানান, সরকারই আমাকে পুরো পৌরসভার অনুমতি দিয়েছে বলে স্বীকার করেন তিনি। সারা বাংলাদেশের মতো রেজিস্ট্রির কাজে তিনিও অন্যদের দিয়ে সম্পন্ন করেন। এবং আয়ের বিষয়ে সঠিক কোনো উত্তর না দিয়ে বছরে রেজিষ্ট্রি বই বাবদ কিছু টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়া অন্যান্য বিষয় নিয়ে জানার চেষ্টা করলে তিনি কোনো সদুত্তর না দিয়ে তার সাথে দেখা করার প্রস্তাব দেন।
অপরদিকে সবকিছুতে ইয়াছিনের শ্বশুর কামাল চেয়ারম্যানের নাম আসায় তার বক্তব্য নিতে চাইলে চেয়ারম্যান কামাল জানান, আমি কিছুই জানি না। অভিযুক্ত হলে আইনগত ব্যবস্থা যা নেওয়ার তাই হোক। নিকা রেজিস্ট্রির সময় ইয়াছিন উপস্থিত থাকেন না জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলে, ও তো রাজনীতি করে তাই এদিক সেদিক যায়, তাই সময় দিতে পারে না হয়তো।
কাজি নিয়োগের গেজেট অনুযায়ী, কোনো নিদিষ্ট স্থানে পদশূণ্য হলে আইন মন্ত্রণালয় বরাবর সাব রেজিষ্ট্রার জেলা রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে চিঠি লিখে নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। তবে দীর্ঘ সময় ধরে কেন উপজেলাটিতে নিয়োগ হয়নি এই বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা রেজিস্ট্রার মো: সালাহ উদ্দিন বলেন, আমি এসেছি বেশি দিন হয় নাই।কতৃপক্ষ অভিযোগ দিলে আমি যথাযথ ব্যবস্থা নিব। তবে অভিযোগ অনুযায়ী এভাবে কেউই কার্যক্রম চালাতে পারেন না এটি অবৈধ। তাকে কে নিয়োগ দিয়েছে সে বিষয়ে আমার জানা নেই।
এইসব বিষয় নিয়ে কাজি নিয়োগ প্রক্রিয়া প্যানেলের উপদেষ্টা ফেনী-০১ আসনের সাংসদ আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম জানান, কাজির বিষয়টি নিয়ে আমি অবগত নই, পরবর্তীতে খতিয়ে দেখে শীঘ্রই যথাযথ ব্যবস্থা নিব।
পৌরসভার ৬ টি ওয়ার্ড থেকে অবৈধ আয়:
মাসিক: ২ লক্ষ ৯৪ হাজার টাকা
বার্ষিক: ৩৫ লক্ষ ২৮ হাজার টাকা
১৩ বছরে: ৪ কোটি ৫৮ লক্ষ ৬৪ হাজার টাকা।
১ টি ইউনিয়ন থেকে অবৈধ আয়:
মাসিক: ৮৪ হাজার টাকা।
বার্ষিক: ১০ লক্ষ ৮ হাজার টাকা।
৫ বছরে: ৫০ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা।
মোট অবৈধ আয় :
মাসিক: ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার টাকা।
বার্ষিক ৪৫ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা।
সর্বমোট: ৫ কোটি ৯০ লক্ষ ৪ হাজার টাকা।